
সমমনা মানবিক সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ডিয়ার জার্নালিস্ট’র উদ্যোগে রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাগিচা রেস্টুরেন্টে ‘আড্ডা ও সাংবাদিকতার ঝুঁকি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক সমিতি (বানাসাস)’র সভাপতি নাসিমা সোমা। ‘ডিয়ার জার্নালিস্ট’র এডমিন খন্দকার হাফিজুর রহমানের (বিপ্লব রেজা) সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘সাংবাদিকতার ঝুঁকি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সেন্টার ফর এডভান্সড রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর রিসার্চ ফেলো ও ঢাবির সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি হাসান নিটোল।
সভায় চলতি বছর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আনজুমান আরা শিল্পী এবং সর্বোচ্চ ভোটে ক্র্যাবের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় মানবজমিনের রুদ্র মিজানকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রবন্ধের ওপর অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক মো. রুহুল কুদ্দুস সরকার, নজরুল ইসলাম বশির, নাজিম মাহমুদ হাসান, সাজু আহমেদ, জাহিদ মামুন, এস এম সামসুল হুদা, মো. জুয়েল হাসান জনি, তাহমিনা শিল্পী, এম এ মামুন মিয়া, মোয়াজ্জেম হোসেন, মনির আহমেদ জারিফ, জাফরুল আলম, নাসরীন গীতি, শামসুদ্দিন হীরা, মাসুদ রানা ও একরামুল ইসলাম বিপ্লব ।
গবেষক হাসান নিটোল বলেন, ‘সাংবাদিকতার ঝুঁকি সবসময়ই ছিলো আছে এবং থাকবে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সব দেশে সব কালেই এই ঝুঁকি ছিলো এবং থাকবে। কম আর বেশি এই যা। সাংবাদিকতার ঝুঁকি নিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে প্রথমেই বলতে হবে এটি একটি মননশীল ও সৃজনশীল পেশা। এই পেশা সবার জন্যে নয়। যাদের লেখলেখির অভ্যাস আছে এবং যাদের লেখা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় কেবল তাদের জন্যই এই পেশা। পাশাপাশি আরেকটি গুণ লাগবে। হতে হবে প্রচণ্ড পরিশ্রমী। আজকের বাংলাদেশের সংবাদপত্র বা মিডিয়ার দিকে যদি তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই? কয়টা পাঠক প্রিয় পত্রিকা আছে বাংলাদেশে? কয়টা মিডিয়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারবে, তাদের নিউজ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে? সুতরাং বর্তমান সময়ে যোগ্য লেখক/যোগ্য সাংবাদিকের অভাব বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি বড় ঝুঁকি।
পাঠক যদি আপনার নিউজ না পড়ে তাহলে সেই পত্রিকার টিকে থাকার আর কোন সম্ভাবনা নেই। প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করলে হয়তো কোন পত্রিকা টেনেটুনে ৫/৭ বছর টিকে থাকতে পারে কিন্তু মনে রাখতে হবে সকল বিনিয়োগকারীই লাভ/ক্ষতির হিসেব-নিকেষ করে। সুতরাং যাদের লেখালেখির অভ্যাস নেই শুধুমাত্র ভোট বাড়ানোর অথবা নিজের কর্মী তৈরির জন্য যেসব সিনিয়র সাংবাদিক অযোগ্য জুনিয়রদের এ পেশায় টেনে আনছেন। তারা এ পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক সাংবাদিক তার নিজের আশেপাশে তাকালেই, এই লোকগুলোকে পেয়ে যাবেন। যারা ভোটার তৈরি করে কিন্তু কোয়ালিটি সাংবাদিক তৈরি করে না। তারাই হলো আপনাদের নিজেদের ভিতর সাংবাদিকতা পেশার দুশমন। পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রী থাকতে পারে বা আপনার রেজাল্ট অনেক ভালো হতে পারে তাই বলে আপনি ভালো সাংবাদিক হবেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং ভালো রেজাল্টধারীদের ধরে ধরে এই পেশায় নিয়োগ দিলেই এই পেশার উৎকর্ষতা সাধন হবে এই ভাবনার কোন যুক্তি নেই। কারণ ভালো রেজাল্ট করা আর ভালো স্ক্রিপ্ট লেখা এক বিষয় নয়। সাংবাদিকতার পেশাগত ঝুঁকি কমাতে ভালো লেখার কোন বিকল্প নেই। একজন ভালো স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাছ থেকেই আমরা দেশ ও মানুষের কল্যাণে ভালো ভালো লেখা আশা করতে পারি। এছাড়া একজন সাংবাদিকের বস্তুনিষ্ঠতা, পক্ষপাতহীনতা, সঠিকতা সেসব যোগ্যতাতো লাগবেই। এতো গেলো, বাংলাদেশে সাংবাদিকরা নিজেরাই কিভাবে নিজেদের পেশাকে বিপদে ফেলছেন তার কথা।
এবার আসি এই পেশাকে বাইরে থেকে কারা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছেন, তাদের বিষয়ে। আধুনিক সাংবাদিকতায় চাকরি হারানোর ভয় এই পেশার অন্যতম একটি ঝুঁকি। পৃথিবীর সব দেশেই করোনাকালে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে বিরাজমান বেসরকারি যে কোন পেশার চেয়ে সাংবাদিকতা পেশা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেসরকারি ব্যাংকের চাকুরির যতটা নিশ্চয়তা বাংলাদেশে আছে, সাংবাদিকদের তাও নেই। কিন্তু ভালো মানের সাংবাদিকতা পেতে হলে চাকরির নিশ্চয়তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আর তা যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মান কখনো ভালো হবে না এবং গণতান্ত্রিক সরকারও গুজব তৈরিকারীদের প্রতিরোধ করতে পারবে না। কারণ গুজব-মিথ্যা তথ্য-অপতথ্য এগুলো প্রতিরোধ করতে হলে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউজগুলোকে দিয়েই করতে হবে। যেসব মিডিয়ার সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদের মাধ্যমেই সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এখন কারো পেটে ভাত না দিয়ে তাকে সারাদিন শুধু পড়ালেখা করো তা বলা যায় না। আবার, কেউ চাকরি হারানোর ভয় মাথায় নিয়ে সত্য কথা লেখা বা ভালো লেখা তৈরি করার যুদ্ধটা চালিয়ে নিতে পারে না। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য যে সময়, একাগ্রতা এবং মনঃসংযোগ দরকার তা একজন চাকরি হারানো ভয়ে থাকা মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তাই এটি দূর করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাধবে কে?
এই দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এই দায়িত্ব মালিককেও নিতে হবে। কিন্তু গলায় কাটা না বিধলে কখনো বাঘ বকের গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পেশাজীবীরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে কঠোর না হলে সাধারণত দাবি আদায় হয়না। তাহলে চাকরির অনিশ্চতা দূর করার উপায় কি? অনেকগুলো উপায় আছে । এক. ভালো মানের সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া। দুই. চাকরিতে ছাঁটাই বন্ধ করা।
বিডি টাইমস / হাছিবুর রহমান